মশা কামড়ানোর কারণ ও প্রতিরোধের উপায়

মশা কেন ও কখন বেশি কামড়ায়? রক্তের গ্রুপ, শরীরের গন্ধ, কার্বন ডাইঅক্সাইড, তাপমাত্রা, পোশাকের রং এবং প্রতিরোধ উপায়।

আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন মশা কেন আপনাকেই বেশি কামড়ায়? আপনার পাশে বসে থাকা ব্যক্তিটির গায়ে মাশা বসছে না কেন? এমন কেন হচ্ছে এই প্রশ্নের উত্তর জানতে নিচের পুরো প্রবন্ধটি মন দিয়ে  আপনাকে পড়তে হবে।

মশা হলো ছোট আকারের একটি ক্ষতিকারক পতঙ্গ। মশার বৈজ্ঞানিক নাম 'Culicidae'। মশার বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে, যেমন এডিস (Aedes) মশা, অ্যানোফিলিস (Anopheles) মশা, কিউলেক্স (Culex) মশাম্যানসোনিয়া (Mansonia) মশা, আর্মিগেরেস (Armigeres) মশা। মশা সাধারণত উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় বেশি দেখা যায়। বিভিন্ন প্রজাতির স্ত্রী মশারা রক্ত খায়। যা তাদের ডিম পাড়ার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে। মশা বিভিন্ন মারাত্মক রোগ যেমন ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ইত্যাদির বাহক হতে পারে।

কি কারণে মশা কামড়ায় দেখুন

মশা কেন বেশি কামড়ায়?

এবার আসা যাক মূল বিষয়ে। মশা কামড়ানোর পেছনে রয়েছে বেশ কিছু কারণ। যেগুলির পড়ে আপনি বুঝতে পারবেন কেন আপনাকে মশা বেশি কামড়ায়।

রক্তের গ্রুপঃ রক্তের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে মশারা বিশেষ করে 'O' গ্রুপের রক্তকে বেশি পছন্দ করে। গবেষণায় দেখা গেছে 'O' গ্রুপের রক্তের গন্ধ মশাদের আকৃষ্ট করে বেশি। তবে এই নয় যে অন্যান্য গ্রুপের মানুষদের মশা কামড়ায় না। বেশি কামড়ায় O গ্রুপের মানুষদের।

শরীরের গন্ধঃ প্রতিটা মানুষের শরীরে ঘামের একটা গন্ধ থাকে। আমাদের শরীরের ঘাম, ব্যাকটেরিয়া এবং কিছু নির্দিষ্ট রাসায়নিক পদার্থ মশাদের আকৃষ্ট করে। প্রাকৃতিকভাবে আমাদের ত্বক থেকে যে গন্ধ বের হয় তা মশাদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়।

কার্বন ডাইঅক্সাইডঃ আমরা শ্বাস ছাড়ার সময় যে কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃশ্বাস রূপে ত্যাগ করি, তা মশাদের জন্য একটি প্রধান সিগন্যাল। মশারা কার্বন ডাইঅক্সাইডের উপস্থিতি অনুভব করতে পারে এবং তার দিকে ছুটে আসে।

শরীরের তাপমাত্রাঃ উষ্ণ তাপমাত্রা মশাদের আকর্ষণ করে। শরীরের তাপমাত্রা বেশি থাকলে মশারা তার দিকে আকৃষ্ট হয়। তবে গ্রীষ্মকালে তুলনায় বর্ষাকালে মশার উপদ্রব  বেশি দেখা যায়।

গর্ভাবস্থাঃ গর্ভবতী মহিলারা সাধারণত বেশি কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করেন এবং তাদের শরীরের তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। এর ফলে মশারা তাদের দিকে বেশি আকৃষ্ট হয়।

পোশাকের রংঃ গাঢ় রঙের পোশাক মশাদের বেশি আকর্ষণ করে। বিশেষ করে কালো, নীল এবং লাল রঙের পোশাক পরিধান করলে মশাদের কামড়ানোর সম্ভাবনা বেশি থাকে।

পরিবেশঃ যেটা সবার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার তা হল পরিবেশ। জলাশয়ের আশেপাশে মশার উপদ্রব বেশি হয়। জমে থাকা জলের মধ্যে মশারা তাদের ডিম পাড়ে এবং সেখানে তাদের বংশবৃদ্ধি হয়। তাই জলসার আশেপাশে আপনি যদি বাস করেন বা থাকেন তাহলে বেশি মশা কামড়ানোর সম্ভাবনা বেড়ে যায়।


কখন মশা বেশি কামড়ায়?

একটি মশার ছবি
মশা যে কোন সময় কামড়াতে পারে। তবে আমাদের এই প্রশ্নে "মশা বেশি কখন কামড়ায়" তা জানার জন্য আপনানার জন্য কয়েকটি পয়েন্ট তুলে ধরা হল। এই পয়েন্টগুলো গুরুত্ব সহকারে দেখলে আপনি মশা কামড়ানোর হাত থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পেতে পারেন।

সন্ধ্যা ও ভোর বেলা

সন্ধ্যা ও ভোরবেলা মশা কামড়ায় সব থেকে বেশি। এই সময়গুলিতে মশারা সবচেয়ে সক্রিয় থাকে। সন্ধ্যা ও ভোরে মশারা খাবারের সন্ধানে বের হয় এবং এই সময়ে মানুষকে বেশি কামড়ায়। মনে রাখবেন গবেষণায় দেখা গেছে মতো রোগ ডেঙ্গি ও ম্যালেরিয়ার মতো রোগ ছড়ানো মশাগুলি এই সন্ধ্যা এবং ভোরের আলো অন্ধকার সময়ে বেশি কামড়ায়।

গরম ও আর্দ্র আবহাওয়া

উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া মশার বংশবিস্তারের জন্য উপযুক্ত সময়। এই সময়ে মশারা দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে এবং তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। গ্রীষ্মের পরে বর্ষার শুরুতে বৃষ্টিপাতের কারণে বাড়ির আনাচে-কানাচে নানা জায়গায় জল জমে এবং এই জমা জলেই মশারা ডিম পাড়ে ও বংশবিস্তার ঘটায়। ফলে মশার সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে মশা কামড়ানোর প্রবণতা বাড়তে থাকে।

বৃষ্টির পর

বৃষ্টিতে যেমন নদী, খাল, বিল, পুকুর ভর্তি হয়ে যায়; ঠিক তেমনি আপনার বাড়ির আশেপাশে থাকা কোন জলাজয়গা, ডোবা, নালা, নর্দমা কিংবা ফুলের টব, খোলা পাত্র ইত্যাদিতে জল জমিতে থাকে। আর এই জলেই জন্ম নেয় মশার লার্ভা।


মশার কামড়ের ক্ষতি কি হয়?

মশার কামড়ে কি হতে পারে দেখুন
মশার কামড় শুধু চুলকানি আর লাল লাল হয়ে ফুলে ওঠার কারণ হিসেবেই সীমাবদ্ধ নয়। এর পিছনে রয়েছে আরও অনেক গুরুতর সমস্যা। যেমন,

  1. মশা চামড়ার নিচে লারভা জমা করে। এর ল্যালিন তারল্য চামড়াকে উত্তেজিত করে। যার ফলে চুলকানি ও লাল দাগ দেখা দেয়।
  2.  কখনো কখনো কামড়ের জায়গায় সুজন হতে পারে এবং ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
  3. কিছু মানুষের ক্ষেত্রে মশার কামড়ে এলার্জিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এতে শ্বাসকষ্ট, ফুসকুড়ি, চোখ ফুলে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
  4. মশার মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ছড়ানো রোগ হলো ম্যালেরিয়া। এটি এক ধরনের পরজীবী সংক্রমণ যা জ্বর, শীত, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব ইত্যাদি সৃষ্টি করে। ম্যালেরিয়া রোগের কারণে শরীরে রক্তের অভাব হতে পারে যা অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা সৃষ্টি করে। গুরুতর ক্ষেত্রে এটি মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
  5. ডেঙ্গি ভাইরাস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এতে তীব্র জ্বর, মাথাব্যথা, চোখের পিছনে ব্যথা, ত্বক ফুসকুড়ি ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। গুরুতর ক্ষেত্রে ডেঙ্গু জ্বর মারাত্মক হতে পারে।
  6. চিকুনগুনিয়া ভাইরাসও মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এতে তীব্র জ্বর, জয়েন্টে ব্যথা, ফুসকুড়ি ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। চিকুনগুনিয়া রোগের কারণে দীর্ঘস্থায়ী জয়েন্টে ব্যথা হতে পারে।
  7. জিকা ভাইরাস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এটি গর্ভবতী মহিলাদের জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকর, কারণ এটি শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশকে প্রভাবিত করতে পারে। জিকা ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
  8. এছাড়াও মশা অন্যান্য রোগ যেমন ইয়েলো ফিভার, ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস ইত্যাদিও ছড়াতে পারে।


মশার কামড় থেকে রক্ষা পাবো কিভাবে?

মশার কামড় থেকে রক্ষা পেতে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে আমাদেরকে বেশ কিছু পদ্ধতি মেনে চলতে হবে।

মশারি ব্যবহার:

ঘুমাতে গেলে মশারি ব্যবহার করুন। অনেকেই আছে যারা ঘুমোতে গেলে মশারি খাটান না। কারণ মশারি খাটানো তাদের কাছে বিরক্তির কারণ। তাই তারা মর্টিন কিংবা গুডনাইট ব্যবহার করে থাকে। তবে মনে রাখবেন মশারি শুধুমাত্র আপনাকে মশার কামড় থেকে রক্ষা করবে না, বরং অন্যান্য বিষাক্ত পোকামাকড় হাত থেকেও কিন্তু আপনাকে রক্ষা করবে।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা:

পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা মনে নতুন জামা কাপড় পরা নয়। মশার কামড় থেকে রক্ষা পেতে আপনাকে ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখতে হবে; বাড়ির আশেপাশের ডোবা, নালা, নর্দমায় জল জমতে দিলে চলবে না; খেয়াল রাখতে হবে বাড়িতে থাকা ফুলের টব কিংবা খোলা কোন পাত্রে জল যাতে জমে না থাকে। এছাড়াও আশে পাশে থাকা বন, জঙ্গল, আগাছা গুলিকেও আপনাকে নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। তবেই আপনি অতিরিক্ত মশার কামড় থেকে রক্ষা পাবেন।

মশার নিধনকারী ওষুধ ব্যবহার:

আগেই বলেছি অনেকেই মশারি না ব্যবহার করে মশা মারার জন্য নানান রকমের কীটনাশক ওষুধ ব্যবহার করে থাকে। তবে মনে রাখবেন এই সফল ওষুধ ব্যবহারের ফলে মশা মরে কি জানি না তবে আপনার শরীরের অনেক ক্ষতি হতে পারে।

গাঢ় রঙের পোশাক পরিহার করুন:

মশা গাঢ় রঙের পোশাকে বেশি আকৃষ্ট হয়। তাই বলে কি আপনি আপনার পছন্দের রং এর পোশাক করবেন না? হ্যাঁ পড়বেন তবে সেই পোশাক যেন হাতের কবজি পর্যন্ত ঢাকা শার্ট কিংবা গোড়ালি পর্যন্ত ঢাকা প্যান্ট হয়।

মশা নিরোধক ক্রিম ব্যবহার করুন:

বাইরে বের হওয়ার আগে মশা নিরোধক ক্রিম ব্যবহার করুন। এর ফলে মশা আপনার দিকে আকৃষ্ট কিছুটা হলে কম হবে।

জানালা-দরজা বন্ধ রাখুন:

সন্ধ্যা হবার কিছুটা আগেই জানলা দরজা বন্ধ করে দিন। কারণ সন্ধ্যার সময়তেই আমরা জানি মশারা বেশি সক্রিয় থাকে। তাই সন্ধ্যার সময় আপনি যদি ঘরের জানালো দরজা বন্ধ করে রাখেন তাহলে ঘরের মধ্যে মশা প্রবেশ করতে পারবে না।

Next Post Previous Post