পৃথিবীর বিষাক্ত গাছ ফল ও ফুল

কিছু উদ্ভিদ, ফল ও ফুল যেমন ম্যানচিনিল, ওলিয়েন্ডার, চেরি এবং ড্যাফোডিল অত্যন্ত বিষাক্ত। এদের সংস্পর্শ বা সেবনে মৃত্যু ঘটতে পারে।

প্রকৃতিতে এমন অনেক উদ্ভিদ, ফল এবং ফুল রয়েছে যেগুলো মানুষকে মুগ্ধ করে, তবে কিছু উদ্ভিদ ও ফল অত্যন্ত বিষাক্ত হতে পারে। এই বিষাক্ত উদ্ভিদ, ফল ও ফুলের সংস্পর্শে এলে বা খেলে মানুষের শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে এবং কখনও কখনও মৃত্যুও ঘটতে পারে। নিচে বিষাক্ত পাতার উদাহরণ, পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত গাছ, বিষাক্ত ফল এবং বিষাক্ত ফুলের বিবরণ দেওয়া হলো।

ক্যাসেটর অয়েল হল পৃথিবীর সবথেকে বিষাক্ত গাছ

কোন গাছের পাতা খেলে মানুষ মারা যায়

পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত গাছের মধ্যে একটি হলো ক্যাসেটর অয়েল প্ল্যান্ট (Castor Oil Plant)। এই গাছটি তার বিষাক্ত বীজের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত, তবে এর পাতা এবং অন্যান্য অংশও মারাত্মক বিষাক্ত হতে পারে।

ক্যাসেটর অয়েল প্ল্যান্ট (Castor Oil Plant)

বৈজ্ঞানিক নাম: Ricinus communis

বিষাক্ত উপাদান: রিসিন (Ricin)  

রিসিন হলো একটি প্রোটিন যা অত্যন্ত বিষাক্ত। এটি মানুষের শরীরের প্রোটিন সংশ্লেষণ প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে, যা কিডনি, লিভার এবং অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যকলাপকে বাধাগ্রস্ত করে। রিসিন শরীরের কোষের ভিতরে প্রবেশ করে রাইবোজোমকে নিষ্ক্রিয় করে, যার ফলে প্রোটিন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় এবং কোষগুলো ধ্বংস হতে শুরু করে।

রিসিনের প্রভাব

রিসিনের প্রভাব অত্যন্ত মারাত্মক এবং দ্রুত ঘটে। এই বিষাক্ত পদার্থের কারণে হতে পারে:

বমি এবং ডায়রিয়া: রিসিন খেলে প্রথমে তীব্র বমি এবং ডায়রিয়া দেখা যায়। এই অবস্থায় শারীরিক দুর্বলতা ও ডিহাইড্রেশন হতে পারে।

পেটে ব্যথা: প্রচণ্ড পেট ব্যথা এবং মাংসপেশীর তীব্র ব্যথা হতে পারে।

ডিহাইড্রেশন: ডায়রিয়ার কারণে শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি বের হয়ে যায়, যা ডিহাইড্রেশন ঘটায়।

অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল: রিসিনের ফলে কিডনি, লিভার এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে।

মৃত্যু: গুরুতর ক্ষেত্রে, রিসিন বিষক্রিয়ার ফলে মৃত্যুও হতে পারে।

সতর্কতা ও প্রতিরোধ

ক্যাসেটর অয়েল প্ল্যান্টের বিষাক্ততা এতটাই মারাত্মক যে এর সাথে সম্পৃক্ত থাকা যেকোনো ব্যক্তি বা প্রাণীর জন্য এটি প্রাণঘাতী হতে পারে। তাই কিছু সতর্কতা অনুসরণ করা উচিত:

শিশু এবং প্রাণী থেকে দূরে রাখা: গাছটি যেখানে রাখা হবে, তা শিশু এবং পোষা প্রাণীর হাতের নাগালের বাইরে রাখতে হবে।

বীজের সংস্পর্শ এড়ানো: গাছের বীজ থেকে দূরে থাকতে হবে এবং গ্লাভস পরিধান করে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।

স্বাস্থ্য পরামর্শ: যদি কোনো ব্যক্তি ভুলবশত ক্যাসেটর অয়েল প্ল্যান্টের অংশ খেয়ে ফেলে, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।


ক্যাসেটর অয়েল প্ল্যান্ট পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত গাছগুলোর একটি, এবং এর রিসিন উপাদান অত্যন্ত মারাত্মক। তাই এই গাছটির সংস্পর্শ থেকে সবসময় সতর্ক থাকা উচিত এবং যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তবে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।


কোন ফল খেলে মানুষ মারা যায়

ডেথ আপেল হল পৃথিবীর সবথেকে বিষাক্ত ফল

প্রকৃতিতে এমন কিছু ফল রয়েছে যেগুলো খেলে মানুষের স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে এবং কখনও কখনও মৃত্যুও ঘটতে পারে।

১. ম্যানচিনিল ফল (Manchineel Fruit)

বৈজ্ঞানিক নাম: Hippomane mancinella  

বিষাক্ত উপাদান: ফোরবোল এস্টার (Phorbol esters)

ম্যানচিনিল ফলের বিষাক্ততা

ম্যানচিনিল ফল যা "বীচ আপেল" বা "ডেথ আপেল" নামে পরিচিত। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বিষাক্ত ফল হিসেবে বিবেচিত। এই ফলের প্রতিটি অংশ এমনকি গাছের বাকল এবং পাতা পর্যন্ত অত্যন্ত বিষাক্ত।

  • ফলটি খেলে প্রথমে মুখে জ্বালাপোড়া এবং গলা শুকিয়ে যায়।
  • এরপর তীব্র পেটে ব্যথা, বমি এবং ডায়রিয়া হতে পারে।
  • ফলটির বিষক্রিয়ার ফলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে, যা মারাত্মক শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা সৃষ্টি করে।
  • গুরুতর ক্ষেত্রে, ফলটির বিষক্রিয়ার কারণে শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যুও ঘটতে পারে।


২. চেরি (Cherry)

বৈজ্ঞানিক নাম: Prunus avium  

বিষাক্ত উপাদান: হাইড্রোজেন সায়ানাইড (Hydrogen Cyanide)

চেরির বিষাক্ততা

চেরি ফলের বীজে হাইড্রোজেন সায়ানাইড থাকে যা অত্যন্ত বিষাক্ত।

  • হাইড্রোজেন সায়ানাইড শরীরে প্রবেশ করলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
  • এটি বমি, মাথাব্যথা, এবং পেটে ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে।
  • শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা এবং নাড়ি ধীর হতে পারে, যা হৃদযন্ত্রের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করে।
  • গুরুতর ক্ষেত্রে, এটি শ্বাসযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ করে এবং হৃদযন্ত্রের কার্যক্রম বন্ধ করে মৃত্যুর কারণ হতে পারে।


৩. এক্কি (Ackee)

বৈজ্ঞানিক নাম: Blighia sapida  

বিষাক্ত উপাদান: হাইপোগ্লাইসিন এ (Hypoglycin A)

এক্কি ফলের বিষাক্ততা

এক্কি ফল বিশেষ করে যখন এটি পাকা না হয় তখন অত্যন্ত বিষাক্ত হতে পারে।

  • পাকা না হওয়া এক্কি ফল খেলে "জ্যামাইকান ভমিটিং সিনড্রোম" হতে পারে। এর ফলে তীব্র বমি, তীব্র পেটে ব্যথা এবং হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে।
  • হাইপোগ্লাইসেমিয়া গুরুতর হলে মৃত্যুও ঘটতে পারে।


৪. স্যাফো ফল (Saffron Fruit)

বৈজ্ঞানিক নাম: Crocus sativus  

বিষাক্ত উপাদান: ক্রোসিন (Crocin), পিক্রোক্রোসিন (Picrocrocin), এবং স্যাফ্রানাল (Safranal)

স্যাফো ফলের বিষাক্ততা

স্যাফো ফলের বেশি পরিমাণে সেবন করলে এটি বিষাক্ত হতে পারে।

  • ফলটির বেশি পরিমাণে সেবন করলে মাথাব্যথা, বমি এবং ডায়রিয়া হতে পারে।
  • শ্বাসকষ্ট এবং হৃদযন্ত্রের সমস্যাও হতে পারে।
  • খুব বেশি পরিমাণে সেবন করলে এটি মৃত্যু ঘটাতে পারে।

প্রকৃতিতে কিছু ফল রয়েছে যেগুলোর সঠিক জ্ঞান ছাড়া খেলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে। উপরিউক্ত ফলগুলি খাওয়া থেকে সবসময় সতর্ক থাকা উচিত এবং কোনো ফল খাওয়ার আগে তার বিষাক্ততা সম্পর্কে জানা জরুরি। যদি কোনো বিষাক্ত ফল খাওয়ার ঘটনা ঘটে, তবে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া আবশ্যক।


বিষাক্ত ফুলের নাম

ওলিয়েন্ডার পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বিষাক্ত ফুল

বিশ্বে অনেক ফুল রয়েছে যেগুলো অত্যন্ত বিষাক্ত। এগুলো কোনোভাবে খাওয়া বা এমনকি ত্বকে লাগলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।

১. ওলিয়েন্ডার (Oleander)

বৈজ্ঞানিক নাম: Nerium oleander  

বিষাক্ত উপাদান: ওলিয়ানড্রিন (Oleandrin), নেরিয়াইন (Neriine)

ওলিয়েন্ডারের বিষাক্ততা

ওলিয়েন্ডার ফুল এবং গাছের প্রতিটি অংশই অত্যন্ত বিষাক্ত। এই গাছটি পৃথিবীর অন্যতম বিষাক্ত গাছ হিসেবে বিবেচিত।

  • ওলিয়ানড্রিন ও নেরিয়াইন কার্ডিয়াক গ্লাইকোসাইড, যা হৃদযন্ত্রের কার্যকলাপে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।
  • ফুলটির বিষক্রিয়ার ফলে বমি, ডায়রিয়া এবং তীব্র পেটে ব্যথা হতে পারে।
  • তীব্র মাথাব্যথা, দৃষ্টিভ্রম এবং শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
  • মারাত্মক বিষক্রিয়ার ক্ষেত্রে, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুও ঘটতে পারে।


২. লিলি অফ দ্য ভ্যালি (Lily of the Valley)

বৈজ্ঞানিক নাম: Convallaria majalis  

বিষাক্ত উপাদান: কার্ডেনোলাইড গ্লাইকোসাইড (Cardenolide Glycosides)

লিলি অফ দ্য ভ্যালির বিষাক্ততা

লিলি অফ দ্য ভ্যালি একটি অত্যন্ত সুন্দর এবং বিষাক্ত ফুল। এর প্রতিটি অংশই বিষাক্ত।

  • কার্ডেনোলাইড গ্লাইকোসাইড হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া ব্যাহত করে।
  • তীব্র বমি, ডায়রিয়া এবং পেটে ব্যথা হতে পারে।
  • মাথাব্যথা, দৃষ্টিভ্রম এবং শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
  • গুরুতর ক্ষেত্রে, হৃদযন্ত্রের কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটতে পারে।


৩. ফক্সগ্লোভ (Foxglove)

বৈজ্ঞানিক নাম: Digitalis purpurea  

বিষাক্ত উপাদান: ডিজিটালিস (Digitalis), ডিজিটালিন (Digitoxin)

ফক্সগ্লোভের বিষাক্ততা

ফক্সগ্লোভ ফুলটি একটি অত্যন্ত বিষাক্ত উদ্ভিদ। এই উদ্ভিদের প্রতিটি অংশই বিষাক্ত।

  • ডিজিটালিস ও ডিজিটালিন হৃদযন্ত্রের কার্যকলাপ ব্যাহত করে, যা হার্ট রেটকে অস্বাভাবিকভাবে বাড়াতে বা কমাতে পারে।
  • তীব্র বমি, ডায়রিয়া এবং পেটে ব্যথা হতে পারে।
  • মাথাব্যথা, দৃষ্টিভ্রম এবং শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
  • মারাত্মক বিষক্রিয়ার ক্ষেত্রে, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটতে পারে।


৪. অ্যাঞ্জেল’স ট্রাম্পেট (Angel's Trumpet)

বৈজ্ঞানিক নাম: Brugmansia  

বিষাক্ত উপাদান: ট্রোপেন অ্যালকালয়েড (Tropane Alkaloids) - স্কোপোলামাইন (Scopolamine), হাইয়োসিয়ামিন (Hyoscyamine)

অ্যাঞ্জেল’স ট্রাম্পেটের বিষাক্ততা

অ্যাঞ্জেল’স ট্রাম্পেটের ফুল ও গাছের প্রতিটি অংশই অত্যন্ত বিষাক্ত।

  • তীব্র বমি, ডায়রিয়া এবং পেটে ব্যথা হতে পারে।
  • মাথাব্যথা, দৃষ্টিভ্রম, শ্বাসকষ্ট এবং স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকলাপে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে।
  • স্কোপোলামাইন হ্যালুসিনেশন সৃষ্টি করতে পারে।
  • গুরুতর বিষক্রিয়ার ক্ষেত্রে, শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটতে পারে।


৫. ড্যাফোডিল (Daffodil)

বৈজ্ঞানিক নাম: Narcissus  

বিষাক্ত উপাদান: লাইকোরিন (Lycorine)

ড্যাফোডিলের বিষাক্ততা

ড্যাফোডিলের বাল্ব এবং ফুলের অংশগুলো বিষাক্ত। 

  • ড্যাফোডিলের বিষক্রিয়ার ফলে তীব্র বমি এবং ডায়রিয়া হতে পারে।
  • পেটে তীব্র ব্যথা হতে পারে।
  • হার্ট রেটের ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে পারে।
  • গুরুতর বিষক্রিয়ার ক্ষেত্রে, শ্বাসকষ্ট এবং হৃদযন্ত্রের কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটতে পারে।

বিশ্বে এমন অনেক ফুল রয়েছে যেগুলোর সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ করে, কিন্তু এদের বিষাক্ততা সম্পর্কে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উপরিউক্ত ফুলগুলি খাওয়া বা এমনকি ত্বকে লাগালে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। তাই এই ফুলগুলির সংস্পর্শ থেকে সবসময় সতর্ক থাকা উচিত এবং যদি কোনো বিষাক্ত ফুলের সংস্পর্শে আসা যায়, তবে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া উচিত।


উপসংহার

প্রকৃতির বিভিন্ন বিষাক্ত উদ্ভিদ, ফল এবং ফুলের মধ্যে রয়েছে ম্যানচিনিল, ওলিয়েন্ডার, চেরি এবং ড্যাফোডিল, যেগুলোর পাতা, ফল এবং ফুল মারাত্মক বিষাক্ত। এই উদ্ভিদ ও ফলগুলোর বিষক্রিয়ার কারণে তীব্র শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে এবং মৃত্যুও ঘটতে পারে। তাই এগুলোর সংস্পর্শ থেকে সবসময় সতর্ক থাকা উচিত এবং যদি কোনো বিষাক্ত উদ্ভিদের সংস্পর্শে আসা যায়, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

Next Post Previous Post